লোপাট শতকোটি টাকা বেবিচকের চার প্রকল্পে

Total Views : 53
Zoom In Zoom Out Read Later Print

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চার মেগা প্রকল্পে ১০০ কোটি টাকা দুর্নীতি ও লোপাটের অভিযোগ উঠেছে।

প্রকল্পগুলো হলো হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের হ্যাঙ্গার নির্মাণ, বিদ্যমান এক্সপোর্ট কার্গোর উত্তরদিকের অ্যাপ্রোন সম্প্রসারণ (দ্বিতীয় পর্যায়), কক্সবাজার বিমানবন্দরের টার্মিনাল ভবন নির্মাণ ও সিলেট আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে ওভারলে প্রকল্প।

অভিযোগ পছন্দের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স (এনডিই) ও মীর আক্তার কোম্পানিকে কার্যাদেশ প্রদান করে বেবিচকের একটি সিন্ডিকেট এই টাকা লোপাট করেছে।

দুদক সূত্র জানায়, সাবেক প্রধান প্রকৌশলী সুধেন্দু বিকাশ গোস্বামীর নেতৃত্বে এই সিন্ডিকেটের নেপথ্যে ছিলেন বেবিচকের সাবেক ও বর্তমান একাধিক প্রকৌশলী। কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানকে দেওয়া দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এক চিঠি থেকে এই তথ্য জানা গেছে। বিষয়টি তদন্ত করছে দুদক। ইতোমধ্যে বেবিচক থেকে এই চার প্রকল্পের যাবতীয় ফাইল ও ডকুমেন্ট জব্দ করেছে দুদক।

বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, চারটি প্রকল্প খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর। এগুলো বাস্তবায়ন হলে বিমানবন্দরগুলোর চেহারা পালটে যাবে। তাই এখানে কোনো ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি হলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।

তিনি বলেন, প্রকল্পগুলোর কার্যক্রম সুষ্ঠু ও দুর্নীতিমুক্তভাবে সম্পাদনের জন্য দুদকসহ সবাইকে সব ধরনের সহায়তা করা হবে। পাশাপাশি তিনি নিজে ও বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে প্রকল্পগুলো সার্বক্ষণিক মনিটরিং করছেন বলেও তিনি জানান।

দুদকের চিঠিতে বলা হয়েছে বেবিচক প্রকৌশলীদের সমন্বয়ে গড়া সিন্ডিকেট বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে পছন্দের ঠিকাদার ন্যাশনাল ডেভেলপার্স ইঞ্জিনিয়ার্স (এনডিই) ও মীর আক্তার কোম্পানিকে কার্যাদেশ দিয়ে সরকারের ১০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর দুদকের অনুসন্ধান তদন্ত-২-এর সহকারী পরিচালক আতাউর রহমান এক চিঠিতে এই চার প্রকল্পের কার্যাদেশ প্রদানের তারিখ, কাজ সম্পাদনের নির্ধারিত সময় ও বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ জানতে চান।

এছাড়া দরপত্রে অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান ও কার্যাদেশপ্রাপ্ত ঠিকাদারদের নাম-ঠিকানা, কাজের অগ্রগতি প্রতিবেদন, সমাপনী প্রতিবেদন ও বর্তমান সময় পর্যন্ত পরিশোধিত বিলের পরিমাণ, প্রকল্প বাস্তবায়ন ও তদারকিতে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নাম জানতে চান।

তারও আগে দুদক আরেক চিঠিতে চার প্রকল্পের কার্যাদেশ পাওয়া দেশি-বিদেশি সব কোম্পানির টেন্ডারসংক্রান্ত যাবতীয় কাগজপত্র দেওয়ার নির্দেশনা দেন বেবিচককে। এর মধ্যে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের হ্যাঙ্গার নির্মাণ প্রকল্পের কার্যাদেশ পাওয়া তিন কোম্পানি বিইউসিজি, এনডিই ও অ্যারোনেস জেভির দরপত্রে পূরণকৃত বিওকিউ, কোম্পানিগুলোর অভিজ্ঞতার সপক্ষে ট্রেড লাইসেন্সের কপি দেওয়ার জন্য বলেন।

ওই চিঠিতে দুদক দরদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর লিকুইড অ্যাসেট, স্পেসিফিক এক্সপিরিয়েন্স ও টার্নওভারের যাচাইকৃত কপি, দাখিলকৃত ক্রেডিট কমিটমেন্ট যাচাইসংক্রান্ত রেকর্ডপত্র, দরপত্রের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে-এমন তথ্য সব দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে অবহিত করা হয়েছিল কি না তার প্রমাণপত্র চায়।

এছাড়া আইটিটি ক্লজের ২৪.২ (কে) অনুযায়ী তথ্যাদির বিপরীতে সব দরদাতা প্রতিষ্ঠানের দাখিলকৃত দলিল সংগ্রহ করে। একইভাবে বিমানবন্দরের অ্যাপ্রোন সম্প্রসারণ প্রকল্পের সিপিটিইউ-এর (সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিট) রিভিউ প্যানেল প্রদত্ত সব রায়ের সম্পূর্ণ কপি, রেসপন্সিভ দরদাতা প্রতিষ্ঠানের লিকুইড অ্যাসেট ও টার্নওভারের যাচাইকৃত কপি, এ বিষয়ে কোর্টের সব সিদ্ধান্তের দলিল ও যেসব দরপত্রের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছিল, তা সব দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দিয়ে অবহিত করা হয়েছিল কি না, এর প্রমাণ জানতে চান।

এছাড়া কক্সবাজার বিমানবন্দরের ইন্টেরিম টার্মিনাল ভবন নির্মাণ প্রকল্প ও সিলেট ওসমানী বিমানবন্দরের রানওয়ে ওভারলে প্রকল্পের টেন্ডারসংশ্লিষ্ট যাবতীয় ডকুমেন্ট জমা দিতে বলে।

দুদক সূত্রে জানা যায়, ৪৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে শাহজালালের হ্যাঙ্গার প্রকল্পটির আওতায় বর্তমানে ২৩৫৮৯ বর্গমিটার জেনারেল এভিয়েশন হ্যাঙ্গার, ৬৫০৬৮ বর্গমিটার হ্যাঙ্গার অ্যাপ্রোন, ২৯৯৮৮ বর্গমিটার নতুন পার্কিং এরিয়া ও ৫ তলাবিশিষ্ট ৫ হাজার বর্গমিটারের ফ্লোরস্পেসের ভবন নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে। প্রকল্পের লিন মিক্সড কংক্রিটের প্রায় ৭০ শতাংশ পিকিউসির প্রায় ৫০ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। জেনারেল এভিয়েশন হ্যাঙ্গার অংশের ১৮৯৫টি পাইলিংয়ের কাজ শেষ হয়েছে।

১১টি স্টিল সুপার স্ট্রাকচারের মধ্যে ৬টির বেশি দণ্ডায়মান হয়েছে। জেনারেল হ্যাঙ্গারের একাংশের নির্মাণকাজ শেষ হলেও পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে ৭৫ শতাংশ। এই নির্মাণ প্রক্রিয়ায় কোনো ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি ও নিæমানের কাজ হয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখছে দুদক।

এছাড়া বিদ্যমান এক্সপোর্ট কার্গো অ্যাপ্রোনের উত্তরদিকের অ্যাপ্রোন সম্প্রসারণ প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭৬ কোটি টাকা। এই প্রকল্পের আওতায় ৭৩৫৪৮ বর্গমিটার কার্গো অ্যাপ্রোন নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে। ইতোমধ্যে প্রকল্পের ৯০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। এটি বাস্তবায়ন হলে অ্যাপ্রোনে অতিরিক্ত ৪টি সুপরিসর উড়োজাহাজ পার্কিং করতে পারবে। এই প্রকল্পটিও দুদকের তদন্তাধীন রয়েছে।

কক্সবাজার বিমানবন্দরের আন্তর্জাতিক টার্মিনাল ভবন নির্মাণ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ২৭৮ কোটি টাকা। বিদেশি ঠিকাদারের সঙ্গে যৌথভাবে এ প্রকল্পটির ঠিকাদার হিসাবে কাজ করছে দেশীয় কোম্পানি এনডিই (ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স)। কিন্তু এনডিইর বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা নানা টালবাহানায় দীর্ঘদিন প্রকল্পের কাজ বন্ধ রেখেছিল।

তাদের নিজস্ব কোনো বিদেশি প্রকৌশলী ছিল না। যার কারণে কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি। মন্ত্রণালয় ও বেবিচকের পক্ষ থেকে একাধিকবার প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেও বিদেশি প্রকৌশলী দেখতে পাননি। বর্তমানে প্রকল্পটির মাত্র ৬০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। ২০২১ সালে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা ছিল। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে এই টার্মিনালের আয়তন হবে ১০৯১২ বর্গমিটার। এ বিষয়টি এখনো তদন্তাধীন রয়েছে বলে দুদুক সূত্রে জানা গেছে।

সিলেট ওসমানী বিমানবন্দরের রানওয়ে ও ট্যাক্সিওয়ে ওভারলেকরণ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৫১ কোটি টাকা। এই প্রকল্পের ঠিকাদার হিসাবে কার্যাদেশ পেয়েছে মীর আক্তার হোসেন জেভি। এই প্রকল্পে কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। দুদক সূত্রে জানা যায়, প্রকল্পটির বিষয়ে তদন্ত করার জন্য তারা দেশীয় ঠিকাদার মীর আক্তার হোসেনের যাবতীয় লিকুইড অ্যাসেট, স্পেসেফিক এক্সপেরিয়েন্স ও টার্নওভারের কপি যাচাইসংক্রান্ত প্রমাণপত্র সংগ্রহ করেছেন।

প্রকল্পটি বেবিচকের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী সুধেন্দু বিকাশ গোস্বামীর নেতৃত্বে শুরু হওয়ায় তাকেও এই ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে।

See More

Latest Photos