জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

Total Views : 55
Zoom In Zoom Out Read Later Print

১৭ মার্চ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০৩তম জন্মবার্ষিকী। ১৯২০ সালের এইদিনে গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গীপাড়ায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম শেখ লুৎফর রহমান এবং মাতার নাম সায়েরা খাতুন। এর আগে বছরব্যাপী বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালিত হয়েছে। সরকার ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ২৬ মার্চ মুজিববর্ষ ঘোষণা করে। দশ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করে। এতে দেশ-বিদেশের সরকার প্রধানসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা অংশগ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের জাতীয় ইতিহাসে সবচেয়ে খ্যাতিমান, সবচেয়ে স্মরণীয় ও বরণীয় নাম। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি তিনি। বঙ্গবন্ধু আর বাংলাদেশ অভিন্ন সূত্রে গ্রথিত। বঙ্গবন্ধু না জন্মালে বাংলাদেশ নামের কোনো দেশ হতো কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এই অর্থেই বলা হয়, বঙ্গবন্ধু মানে বাংলাদেশ, বাংলাদেশ মানে বঙ্গবন্ধু। ব্যক্তিনাম ও দেশনাম এভাবে একাকার হয়ে যাওয়ার নজির বিশ্বে বিরল। তিনি ছিলেন জাতীয় জাগরণের তুর্যবাদক। জাতিকে উজ্জীবিত ও প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে তার অবদান বলতে গেলে একক। তিনি ভাষাভিত্তিক ও জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে আমাদের অশেষ ঋণে আবদ্ধ করে গেছেন। আজ গভীর শ্রদ্ধায় ও কৃতজ্ঞতায় আমরা তাকে স্মরণ করছি।

বাংলাদেশ বাংলাভাষীদের স্বাধীন দেশ, বাঙালিরও একমাত্র স্বাধীন দেশ। এদেশের ৯২ শতাংশ মানুষ মুসলমান। অন্যরা অন্যান্য ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষ। আমাদের জাতিসত্তার প্রধান দুটি উপাদানের একটি হলো বাঙালিত্ব অপরটি মুসলমানিত্ব। বাঙালিত্ব ও মুসলমানিত্বের মধ্যে কোনো বিরোধ বা পার্থক্য নেই। এরা একে অপরের পরিপূরক। নাগরিকত্বের পরিচয়ে আমরা বাংলাদেশি। বঙ্গবন্ধু বাঙালি ও মুসলমান দুটি পরিচয়কেই সমান মর্যাদা ও গুরুত্ব প্রদান করেছেন। বস্তুত: এই দুটি পরিচয় প্রতিষ্ঠার জন্যই তিনি জীবনব্যাপী সাধনা ও সংগ্রাম করেছেন। স্মরণ করা যেতে পারে, ব্রিটিশ ভারতে যখন মুসলমানরা রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও অন্যান্য দিক থেকে অত্যন্ত অবনত ও পিছিয়ে ছিল, তখন তিনি মুসলমানদের জাগরণ ও তাদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছেন। তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে কেন মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র, স্বাধীন রাষ্ট্র প্রয়োজন, তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং বলেছেন, ‘অখন্ড ভারতে যে মুসলমানদের অস্তিত্ব থাকবে না, এটা মনে প্রাণে বিশ্বাস করতাম।’ মুসলমানদের স্বতন্ত্র-স্বাধীন রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় তিনি অক্লান্ত শ্রম ও সংগ্রাম করেন, এমনকি জীবনের ঝুঁকি পর্যন্ত নেন। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরে তিনি লক্ষ্য করেন, তৎকালীন পূর্ববঙ্গ কার্যত পশ্চিম পাকিস্তানের কলোনী হয়ে উঠছে। লক্ষণটা শুরুতেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে রাষ্ট্র ভাষার প্রশ্নে শাসকদের বিরূপ মনোভাবের মধ্য দিয়ে। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উপেক্ষিত হলে শুরু হয়ে যায় ভাষার দাবিতে আন্দোলন। ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাঝামাঝি সময়ে এ আন্দোলন শুরু হয়। ৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি গুলি চলে এবং সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার প্রমুখ শাহদাত বরণ করেন। বঙ্গবন্ধু ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। ভাষা আন্দোলন থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, একিভূত পাকিস্তানে বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার ও মুক্তির কোনো পথ নেই। এটা সবচেয়ে আগে এবং সবচেয়ে ভালোভাবে বোঝেন বঙ্গবন্ধু। পরবর্তীকালের সকল আন্দোলন সংগ্রাম এই লক্ষ্যেই পরিচালিত হয়েছে এবং সব আন্দোলনেরই নেতৃত্ব দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। তার ৬ দফা স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দিগদর্শন। এ আন্দোলনের পথ ধরেই ৭০-এর নির্বাচন, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা। মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধু প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখতে না পারলেও তার নামেই যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে এবং দেশ স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ফিরে এসে বঙ্গবন্ধু দেশের হাল ধরেন। যুদ্ধবিধস্ত দেশ পুনর্গঠনে আত্মনিয়োগ করেন। শান্তিপূর্ণ, স্বয়ম্ভর, সমৃদ্ধ দেশ প্রতিষ্ঠার নতুন সংগ্রাম শুরু করেন। ‘সোনার বাংলা’ গড়া ছিল তার স্বপ্ন। আমাদের দুর্ভাগ্য, ঘাতকরা তার এ স্বপ্ন বাস্তবায়নের সুযোগ দেয়নি। তাকে হত্যা করে বস্তুত তারা বাংলাদেশের আত্মাকেই হত্যা করে। জাতীয় ইতিহাসে এর চেয়ে মর্মান্তিক, দুঃখজনক ঘটনা আর নেই।

বঙ্গবন্ধু অমর, চিরঞ্জীব। তার দেহ, তার জীবন্ত অস্তিত্ব আমাদের সামানে নেই বটে; তবে তিনি এদেশের সর্ব প্রজন্মের মানুষের চেতনায় ও হৃদয়ে স্থায়ী আসন পেতে বসে আছেন। বাংলাদেশ যতদিন থাকবে, এ জাতির একটি মানুষ যতদিন জীবিত থাকবে, তার নাম ততদিন বেঁচে থাকবে। বঙ্গবন্ধু নিজেকে বাঙালি হিসেবে যেমন গর্ব করতেন, তেমনি গর্ব করতেন মুসলমান হিসেবেও। তার পূর্ব পুরুষ একদা ইরাক থেকে ইসলাম প্রচারের জন্য এদেশে আসেন। একারণেই ইসলামের প্রতি তার বিশ্বাস ও অনুরাগ ছিল সহজাত। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে এক বেতার ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন: ‘আমরা বিশ্বাসী ইসলামের বিশ্বাসে। আমাদের ইসলাম হযরত রাসূলে কারিম (স.) এর ইসলাম। যে ইসলাম শিক্ষা দিয়েছে ন্যায় ও সুবিচারের মন্ত্র।’ তিনি গর্ব করতেন এই বলে যে, ‘আমি মুসলমানের সন্তান।’ গর্বের সঙ্গে তার দেশের পরিচয় তুলে ধরতেন এভাবে: ‘বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র’। সাড়ে তিন বছরেরও কম সময় তিনি রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনা করেন। এই সময়ের মধ্যে ইসলামের সেবায় তিনি ব্যাপক ভূমিকা ও অবদান রাখেন। তিনি মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়নে নীতিনির্দেশনা প্রদান করেন ও মাদরাসা খুলে দেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার। দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার দ্ব্যর্থহীন উক্তি চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। তিনি বলেছিলেন, ‘সবাই পায় সোনার খনি, আমি পেয়েছি চোরের খনি।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘বিদেশ থেকে আমি চেয়ে আনি, আর চাটার দল তা খেয়ে ফেলে।’ দুঃখের বিষয়, বঙ্গবন্ধুর দুর্নীতিমুক্ত সোনার বাংলায় এখনও দুর্নীতি-অনিয়ম রয়ে গেছে। হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট, লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এর কার্যকর প্রতিকার হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করে চলেছেন। আমরা আশা করি, জাতির পিতার কন্যা হিসেবে তিনি দুর্নীতিবাজদের রেহাই দেবেন না এবং দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে সক্ষম হবেন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষার সোনার বাংলাকে অব্যাহত গতিতে এগিয়ে নেবেন। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছে। এটা একটি বড় অর্জন। বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক মুক্তির যে স্বপ্ন তা এক ধাপ এগিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে যে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও নীতি গ্রহণ করা হয়েছে, তার মাধ্যমে আগামী বিশ বছরে দেশ উন্নত দেশে পরিণত হবে। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় পরিণত হবে। তবে আমরা কি সবক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করতে পেরেছি? বাস্তবতা হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, স্বপ্ন ও নীতি এখন অনেক ক্ষেত্রে স্লোগানে পরিণত হয়েছে। তাঁর গড়া দল ও নেতা-কর্মীদের মধ্যে তাঁর দর্শন বাস্তবায়নে মনোযোগ কম পরিলক্ষিত হচ্ছে। এটা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়। বঙ্গবন্ধুর সারাজীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সকলকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। বর্তমানে দেশের সাধারণ মানুষ নানা সমস্যা ও প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করছে। নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতিতে তারা দিশেহারা হয়ে পড়েছে। বঙ্গবন্ধু সারাজীবন দুঃখী মানুষের কথা বলেছেন। তাদের মুখে হাসি ফোটাবার জন্য নিরন্তর কাজ করেছেন। সোনার বাংলার মানুষ সুখে থাকবে-এ স্বপ্ন আজীবন লালন করেছেন। তাঁর এ স্বপ্ন যাতে মলিন হয়ে না পড়ে, এ ব্যাপারে সরকারকে উদ্যোগী এবং দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হতে হবে। মানুষের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করে তাদের মুখে হাসি ফোটাতে হবে।


See More

Latest Photos