কিছু কথাসেকেন্ড রিপাবলিক নিয়ে

Total Views : 46
Zoom In Zoom Out Read Later Print

সেকেন্ড রিপাবলিক, গণপরিষদ, ইনকিলাব জিন্দাবাদ, নতুন বন্দোবস্ত ইত্যাদি শব্দ বলে রাজনীতিকে কিছুটা দুর্বোধ্য করে তুলেছে ছাত্রদের নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি- এনসিপি। প্রথাগত রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে এসবের অর্থ ও ব্যাখ্যা একটু জটিল। ছাত্ররা মূলত স্বৈরাচার বা ফ্যাসিস্ট তৈরির পথ বন্ধ করতে চায়। সেই চাওয়াটার কথা বলছে একটু ক ঠিন করে। বর্তমান সংবিধানের অধীনে যিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন তার সামনে স্বৈরাচার হওয়ার পথ বেশ প্রশস্ত। তার যা ইচ্ছা তা করার ব্যবস্থা আছে বিদ্যমান ব্যবস্থায়। দলীয় প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিলে সংসদ সদস্যের পদ শূন্য হবে। অথচ, প্রধানমন্ত্রীর মত বা নির্দেশেই প্রস্তাবগুলি সংসদে আসে। এর জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করে নির্বাচন করার কোনো যুক্তি নেই। প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে নিযুক্তি দেন। অর্থাৎ রাষ্ট্রপতিও জনগণের সরাসরি ভোট নির্বাচিত কেউ না, রাবার স্ট্যাম্প। আবার প্রধানমন্ত্রী নিজেও জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত নন। আসলে তিনি একটি সংসদীয় এলাকার একজন নির্বাচিত সংসদ সদস্য মাত্র, তিনি দেশের সমগ্র জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন না। তাহলে বর্তমান রিপাবলিককে আসলেই একটা রাবার স্ট্যাম্প রিপাবলিক বলা যেতে পারে। সংবিধান আছে, সংসদ আছে, কিন্তু দেশ চলে পরিবারের কথায়, জনগণের কথায় না। এর জন্যই নতুন সংবিধান বা ব্যাপকভাবে সংস্কৃত সংবিধান দরকার।

কেবল বাংলাদেশের মানুষ নন, রাজনীতিকরাও নতুন তত্ত্ব ও কঠিন কথায় ভয় পান। এক সময় বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের বুলিতে আচ্ছা রকমের গ-গোল পাকিয়ে তাদের রাজনীতিটারই সর্বনাশ করে দিয়েছিলেন জাসদ নেতারা। জাসদের গোড়া পত্তনকারীরা ছিলেন মেধায় টইটম্বুর। তার ওপর তারুণ্যের ওই ঝলকরা ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বিপ্লবী চেতনার অংশ। বিভক্ত ছাত্রলীগ নিয়ে হলেও জাসদ গঠনেও ছিল রিপাবলিকের কথা। আর হাজার হাজার মেধাবী তারুণ্যের রাজনীতি ও জীবন দুটারই বরবাদ ঘটেছে। এখনকার তারুণ্য দেশে ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠা করে ছাড়ার গো ধরেছে। কিন্তু সেকেন্ড রিপাবলিক কী সেটা খোলাসা করতে পারছেন না। ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ ধারণাটি ফ্রান্সের ইতিহাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। পোল্যান্ড, কোস্টারিকাসহ আরও কয়েকটি দেশের ইতিহাসের সঙ্গেও মিশে আছে এটি। এটি এমন একটি রাজনৈতিক ধারণা, যা বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। সার্বিকভাবে এমন ধারণায় কোনো দেশে পূর্ববর্তী শাসনব্যবস্থার বদল ঘটিয়ে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বা শাসনকাঠামো গ্রহণ করাকে বোঝায়। বিপ্লব, অভ্যুত্থানের পর এমন নানা শব্দ ও কথা যুগে যুগে এসেছে।

ফ্রান্সে এখন পঞ্চম রিপাবলিক চলছে। দেশটি একসময় রাজতন্ত্রের অধীন ছিল। ১৭৮৯ থেকে ১৭৯৯ সাল পর্যন্ত ফরাসি বিপ্লব চলে। এর মধ্য দিয়ে রাজতন্ত্রের পতন ঘটে। তবে বিপ্লব চলার মধ্যেই ১৭৯২ সালে ফ্রান্সে প্রথম রিপাবলিক ঘোষণা করা হয়। তা টিকে ছিল ১৮০৪ সাল পর্যন্ত। এরপর আবার রাজতন্ত্র শুরু হয়। চলে ১৮৪৮ সাল পর্যন্ত। ওই বছর ফ্রান্সে দ্বিতীয় রিপাবলিক ঘোষণা করা হয়। এটি টিকে ছিল ১৮৫২ সাল পর্যন্ত। সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য হলেও ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ ফ্রান্সের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়। দফায় দফায় শাসনব্যবস্থা বদলে ফ্রান্সে এখন এসেছে পঞ্চমে। বাংলাদেশে সেই আবহ পুরোপুরি নেই। তবে, ফ্যাসিস্ট জন্মানোর ধারা এখানে লম্বা। যে ক্ষমতায় যায়, সেই এখানে কম-বেশি দানবীয় হয়ে যায়। শেখ হাসিনার জমানায় সেটা হয়েছে মাত্রা ছাড়া। এর একটা অবসান অবশ্যই হওয়া দরকার। কিন্তু, ছাত্ররা সেটাকে একটু কঠিন করে তুলেছে তাদের বাচনে-বচনে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর গত বছরের ২২ অক্টোবর ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ ধারণা প্রথম আলোচনায় এনেছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। সেদিন বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা ও রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবিতে ‘বিপ্লবী ছাত্র-জনতার গণজমায়েত’ থেকে পাঁচ দফা দাবি জানানো হয়েছিল। সেটিরই একটি ছিল ‘জুলাই বিপ্লবের স্পিরিটের আলোকে ২০২৪-পরবর্তী বাংলাদেশ বিনির্মাণে নতুন করে প্রক্লেমেশন অব রিপাবলিক ঘোষণা এবং এর ভিত্তিতে দেশে বিদ্যমান গণতান্ত্রিক ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলের মতের ভিত্তিতে দেশ পরিচালনা করা। এরপর ওই পাঁচ দফা নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির প্রতিনিধিরা। শেষ পর্যন্ত দলগুলোর কাছ থেকে এসব দাবির ব্যাপারে সরাসরি ইতিবাচক সাড়া না পেয়ে ‘সেকেন্ড রিপাবলিকের’ ধারণাটি পরে আর সেভাবে সামনে আসেনি। যদিও জুলাই অভ্যুত্থানের নেতাদের কেউ কেউ বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন সময় এ বিষয়ে কথা বলেছেন। এ ছাড়া বর্তমান সংবিধান বাতিলের দাবিও কয়েক মাস ধরেই করে আসছেন তাঁরা।

গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশ করতে চেয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এ বিষয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটিও তাদের সঙ্গে ছিল। ঘোষণাপত্র প্রকাশ সামনে রেখে ২৯ ডিসেম্বর ঢাকার বাংলামোটরে নিজেদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেছিলেন, ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রের’ মাধ্যমে বাহাত্তরের মুজিববাদী সংবিধানের ‘কবর’ রচিত হবে।

ঘোষণাপত্রে ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ ঘোষণার কোনো বিষয় আছে কি না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে সেদিন হাসনাত আবদুল্লাহর উত্তর ছিল, ‘সেকেন্ড রিপাবলিক (দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র) আইনগত বিষয়। সেকেন্ড রিপাবলিকের বিষয়ে আমরা এখন যাচ্ছি না।’ তখন যাচ্ছি না বলা হলেও এখন পারলে নির্বাচনের আগেই হুকুমত কায়েম করে ফেলেন। জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতারা বলছেন, এ ভূখ-ের মানুষের সব লড়াই একীভূত করে মানুষের আকাক্সক্ষার ভিত্তিতে সংবিধান ও রাষ্ট্র পুনর্গঠনের নামই ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’। আর ব্যাখ্যায় বলা হচ্ছে, ‘প্রথম রিপাবলিক হচ্ছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন। মুক্তিযুদ্ধের পর যে সংবিধান প্রণীত হয়েছে, সেই সংবিধানে কিছু কাঠামোগত ত্রুটির কারণে সরকার ও প্রধানমন্ত্রী কর্তৃত্বপরায়ণ ও ফ্যাসিবাদী হয়ে ওঠে। এই কাঠামো বারবার সংশোধন করা হয়েছে।’ সার্বিকভাবে এমন ধারণায় কোনো দেশে পূর্ববর্তী শাসনব্যবস্থার বদল ঘটিয়ে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বা শাসনকাঠামো গ্রহণ করাকে বোঝায়। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এমনভাবে স্বাধীন ও শক্তিশালী করতে হবে, যাতে নাগরিকেরা শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান জনগণের রক্ষক হয়। এই পরিবর্তনগুলো করতে হলে সংবিধানে খুব র‌্যাডিকেল পরিবর্তন প্রয়োজন। এটিকেই তারা সেকেন্ড রিপাবলিক বলছেন।

কথাগুলো সাদামাটাই। কিন্তু প্রকাশ-প্রসার কঠিনেরও কঠিন। বিতাড়িত আওয়ামী লীগের এ নিয়ে হা-না বলার সুযোগ নেই। কারণ, শত চেষ্টায় চাইলেও পরিশুদ্ধ হয়ে সুস্থ রাজনীতিতে ফিরে আসার ন্যূনতম সম্ভাবনা আপাতত নেই আওয়ামী লীগের। ক্ষমতাকালের উন্মাদনা এবং পলায়ন-পরবর্তী বাচন-বচন ও আচরণে নিজের এবং দলের সর্বনাশ নিজেই করেছেন শেখ হাসিনা। প্রতিশোধপরায়ণ হাসিনার হাতে আওয়ামী লীগের দূষণের মধ্য দিয়ে বিএনপির জন্য পরম আশীর্বাদ। কেবলই এগিয়ে যাওয়ার সোপান দলটির। কিন্তু ঘটনার পরম্পরায় বিএনপির সেই অভিযাত্রায় মহাছেদ এ সেকেন্ড রিপাবলিকসহ ছাত্রদের গড়া দলের মতিগিতি নিয়ে। দিন যত গড়াচ্ছে, বিএনপির যন্ত্রণার বোঝা তত বাড়ছে। ধারণাতীত ও অবিশ্বাস্যভাবে তাদের শক্ত প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছে সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে চলা এনসিপি। মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে ব্যতিক্রমী আয়োজনে আত্মপ্রকাশ ঘোষণার পর সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ও রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করেও সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠায় অটল থাকার কথা জানিয়েছেন দলটির নেতারা।

রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠার পর প্রথম কর্মসূচির অংশ হিসেবে তারা বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানালেন। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে নতুন এ দলের আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলাম বলেন, এনসিপির প্রথম কাজ হবে তৃণমূলে দলীয় কার্যক্রম বিস্তৃত করা। পুরোনো সংবিধান রেখে নতুন দেশ গড়া সম্ভব নয় জানিয়ে তিনি বলেন, নতুন প্রজাতন্ত্র গড়তে প্রয়োজন নতুন সংবিধান ও গণপরিষদ নির্বাচন। শর্ত পূরণ করে নিবন্ধনের জন্য শিগগিরই নির্বাচন কমিশনে আবেদন করবেন তারা। জুলাই গণহত্যার বিচারের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের ফয়সালা করার সিদ্ধান্ত তাদের। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসসহ কয়েকজন উপদেষ্টার সরাসরি আশীর্বাদ তাদের দিকে। তবে ফাউ বা মাগনায় নয়; এনজিও স্টাইলে তাদেরকে কঠোর শ্রমে-ঘামে তৃণমূল থেকে শক্তিমান হওয়ার পথ বাতলে দেওয়া হয়েছে।

See More

Latest Photos