নতুন স্বাধীনতা দিবস নতুন প্রেক্ষাপটে

Total Views : 25
Zoom In Zoom Out Read Later Print

আজ ২৬ মার্চ। মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। আমাদের স্বাধীনতা ৫৪তম বর্ষ অতিক্রম করে ৫৫তম বর্ষে পদার্পণ করলো। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যার সূচনা করে। হানাদার বাহিনীর এই হামলা ও গণহত্যার বিরুদ্ধে তখনই দুর্বার প্রতিরোধ শুরু হয়ে যায়। দীর্ঘ ৯ মাসের মরণপণ সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশমাতৃকা হানাদারমুক্ত হয়। মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ শাহাদাত বরণ করেন, অসংখ্য মানুষ আহত হন, বহু মা-বোন সমভ্রম হারান, স¤পদ-স¤পত্তির বেশুমার ক্ষতি হয়। এত কিছুর বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা, যার প্রতীক্ষায় যুগযুগ ধরে অপেক্ষায় ছিল দেশের মানুষ। স্বাধীনতা যেকোনো জাতির জন্য পরম আকাক্সক্ষার বিষয়। আত্মপ্রতিষ্ঠার অধিকার, গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, সুশাসন, অর্থনৈতিক মুক্তি, বৈষম্যের অবসান ইত্যাদি ছিল আমাদের স্বাধীনতার লক্ষ্য। এইসব লক্ষ্য অর্জনের প্রত্যাশা নিয়েই জাতি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং বিপুল ত্যাগ ও মূল্যে স্বাধীনতার স্বপ্নের বন্দরে উপনীত হতে সক্ষম হয়েছিল। শুরুতেই স্বাধীনতার তিনটি মৌলিক লক্ষ্যের প্রতি গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছিল। এই তিনটি মৌলিক লক্ষ্য হলো, সামাজিক ন্যায়বিচার, মানবিক মর্যাদা এবং সাম্য। এর সঙ্গে গণতান্ত্রিক অধিকার, সুশাসন ও অর্থনৈতিক মুক্তির বিষয়গুলোও ওতপ্রোতভাবে সংযুক্ত ছিল।

সমৃদ্ধ, আত্মনির্ভরশীল ও আত্মমর্যাদার দেশ গঠন লাখো মুক্তিযোদ্ধার স্বপ্ন ছিল। সেই লক্ষ্য এখনো অনেক দূরে। এখন পর্যন্ত এই অঙ্গীকার-প্রতিজ্ঞা অনেকটাই অপূর্ণ রয়ে গেছে। এর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি, ভারতীয় আধিপত্যবাদ এবং স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছর স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ফ্যাসিস্ট শাসন ব্যবস্থা কায়েম করেছিল। দেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাস নিজেদের মতো করে বয়ান করেছে। ইতিহাসের বিকৃতি, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের অস্বীকৃতিসহ বানোয়াট গাল-গল্প প্রচার করেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে দেশকে বিভক্তির মধ্যে ঠেলে দিয়েছিল। স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষের ধোঁয়া তুলে ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতির মধ্য দিয়ে ভারতের আধিপত্যবাদকে অবারিত করে দিয়েছিল। বাংলাদেশকে ভারতের করদরাজ্যে পরিণত করেছিল। দেশের মানুষকে হাসিনা তার ফ্যাসিজমের মধ্যে রেখে পরাধীন করে রেখেছিল। অধিকার নিয়ে দেশের মানুষের মাথা তুলে দাঁড়িয়ে শ্বাস নেয়ার মতো পরিস্থিতি ছিল না। যারাই হাসিনার বিরুদ্ধে কথা বলতে গেছে, তাদেরকে খুন, গুম, অপহরণ, নিপীড়ন, নির্যাতন, জেল-জুলুমের শিকার হতে হয়েছে। মানুষের যখন আর পিছু হটার জায়গা ছিল না, তখনই তারা হাসিনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। ছাত্র-জনতার জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ৩৬ দিন পর ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতন হয় এবং তাকে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যেতে হয়। নতুন প্রেক্ষাপটে, হাসিনার কবল থেকে দেশ মুক্ত হওয়াকে নতুন স্বাধীনতা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। হাসিনার শাসনামল ছিল ইতিহাস বিকৃতি ও উন্নয়নের ফানুস উড়ানোর গল্প। সে সময় কথায় কথায় বলা হতো, দেশ সিঙ্গাপুরকে ছাড়িয়ে ইউরোপের দেশে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে, লুটপাট করে লাখ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে। জিডিপি, মাথাপিছু আয়, দারিদ্র্য কমা, খাদ্যে স্বংসম্পূর্ণতা অর্জনের মিথ্যা পরিসংখ্যান দিয়ে মানুষকে ভুলিয়ে রাখা ও হাসিনার উন্নয়নের গল্প ছড়িয়ে দেয়া হতো। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নামে উন্নয়ন উদযাপন করা হতো। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হাসিনা যখন পালিয়ে যায়, তখন অর্থনীতির এক ধ্বংস স্তুপের মধ্যে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। দেশের অর্থনীতি বলতে কিছু ছিল না। এ পরিস্থিতি থেকে দেশের অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড় করানোর প্রচেষ্টা চলমান। ইতোমধ্যে সরকারের সাড়ে সাত মাস অতিক্রম করেছে। এই সময়ের মধ্যে অর্থনীতি কতটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে তা বিচার সাপেক্ষ। যদিও তলানিতে গিয়ে ঠেকা অর্থনীতিকে টেনে তোলা সহজ নয়। এখনো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। মানুষের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি শোচনীয়। তাদের হাতে টাকা নেই। বেকারত্ব ও দারিদ্র্য হু হু করে বাড়ছে। এই সরকারের সময়েই শত শত কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। সালমান এফ রহমান গ্রেফতার হওয়ায় বেক্সিমকোর মতো বড় শিল্প গোষ্ঠীর অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। শিল্পকারখানা বন্ধ হওয়ায় লাখ লাখ মানুষ বেকার হয়েছে। অর্থনীতির এই সেটব্যাক থেকে উত্তরণের সঠিক রূপরেখাও দৃশ্যমান নয়। এ পরিস্থিতিতেই আগামী জাতীয় নির্বাচন এগিয়ে আসছে। নির্বাচনে নতুন সরকার গঠিত হবে। দেশ এক নতুন পরিস্থিতিতে পরিগ্রহ করবে।
স্বাধীনতার ৫৫ বছরে এসেও আমাদের লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হয়নি। রাজনৈতিক বিভেদ-বিভাজন বন্ধ হয়নি। অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে দেশের স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এখনো মারামারি-হানাহানি বিদ্যমান। পরিসংখ্যানগত মিথ্যা বয়ানের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রয়েছে। এ থেকে বের হয়ে প্রকৃত উন্নয়নের দিকে ধাবিত হতে হবে। আমাদেরকে সামনে তাকাতে হবে। পুরনো অপসংস্কৃতি মারামারি-হানাহানি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস নতুন প্রজন্মকে জানাতে হবে। হাসিনার পুরো শাসনামলে একটি প্রজন্ম স্বাধীনতার বিকৃত ইতিহাস শুনে বড় হয়েছে। তাদের সামনে ইতিহাসের যে বিকৃতি হয়েছে, তা ঠিক করে তুলে ধরতে হবে। স্বাধীনতার ৫৫ বছরে পা দিয়ে আমরা আর বক্তৃতাবাজি ও গালগল্প শুনতে চাই না। আমরা কাজ দেখতে চাই। কথা কম, কাজ বেশিÑএই নীতির প্রয়োগ দেখতে চাই। দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও মানুষের জীবনের হাহাকারের চিত্র দেখতে চাই না। মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন চাই। নতুন স্বাধীনতায় এসে পুরনো সেই পারস্পরিক দোষারোপের রাজনীতি কাম্য হতে পারে না। পৃথিবী বদলে গেছে। আমাদেরও বদলে যাওয়া বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ক্ষেত্রে আপসহীন থাকতে হবে। বলা হয়, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা অনেক কঠিন। স্বাধীনতা তখনই সুরক্ষিত থাকে যখন জাতি ই¯পাতকঠিন ঐক্যে দৃঢ়বদ্ধ থাকে। নতুন প্রেক্ষাপটে এখন এই ঐক্য ধরে রাখা জরুরি। ঐক্য ধরে রেখে আমাদেরকে শিক্ষা-দীক্ষা, মেধা-মনন, ধর্মনিষ্ঠা, মূল্যবোধ, সাহিত্য-শিল্প, সংস্কৃতি, সৃজনশীলতা ইত্যাদিতে এগিয়ে উন্নত জাতিতে পরিণত হতে হবে।

See More

Latest Photos