আয়কর কতটা যৌক্তিক ন্যূনতম দুই হাজার টাকা

Total Views : 27
Zoom In Zoom Out Read Later Print

নতুন বাজেটে রিটার্ন দাখিল করলেই দুই হাজার টাকা কর দেয়ার যে প্রস্তাবনা করা হয়েছে, এ নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে।

সামাজিক মাধ্যমগুলোয় অনেকেই এই প্রস্তাবের সমালোচনা করে একে অন্যায্য বলে বর্ণনা করেছেন। আবার অনেকে এর পক্ষেও অবস্থান নিয়েছেন।

বাজেটে বলা হয়েছে, আয় না থাকলেও একজন টিআইএনধারী ব্যক্তিকে আয়কর সনদ নিতে হলে দুই হাজার টাকা ন্যূনতম আয়কর দিতে হবে। ৪৪ ধরনের সেবা নিতে হলে এই আয়কর সনদ জমা দিতে হবে।

বাজেট ঘোষণায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, ‘আমি করযোগ্য আয়ের কম কিন্তু সরকারে এই অংশগ্রহণ প্রচারের লক্ষ্যে সরকার থেকে সেবা নিতে আয়কর রিটার্ন জমা দেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে এমন যোগ্য ব্যক্তিদের মধ্যে ন্যূনতম কর দুই হাজার টাকা করার প্রস্তাব করছি।‘

বর্তমানে বাংলাদেশে ৮৮ লাখ মানুষের কর শনাক্তকরণ নম্বর বা টিআইএন রয়েছে। তবে গত বছর আয়কর রিটার্ন দাখিল করেছেন ৩২ লাখ মানুষ। সরকার নতুন অর্থ বছরে যে বিপুল রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, সেটা পূরণে নূন্যতম আয়কর আদায়ের এই পথ সরকার নিয়েছে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন।

ন্যূনতম আয়কর নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে যেসব মতামত
বাজেট ঘোষণার পরেই প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন ওই প্রস্তাবনার সমালোচনা করে বলেন, 'যার করযোগ্য আয় নেই, তার জন্য কর বাধ্যতামূলক করা বৈষম্যমূলক ও অন্যায্য। মানুষের জন্য বোঝা হয়ে যাবে।'

তিনি বলেছেন, ‘’যে কর দেওয়ার যোগ্য, ক্ষমতা-আয় আছে সেই তো কর দেবে, কিন্তু যার নাই তার ওপর আবার বসিয়ে দিলাম। এটা সাংঘর্ষিক ও বৈষম্যমূলক। নৈতিকভাবেও এটা ঠিক না। এটা অর্থনৈতিক চাপ বাড়াবে। ফলে মূল যে উদ্দেশ্য ছিল সেটিও নষ্ট হয়ে গেল।‘’

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বর্তমানে মূল্যস্ফীতির কারণে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এমনিতেই চাপের মধ্যে রয়েছে। আয়কর দেয়া নিয়ে তাদের মধ্যে এখনো ভীতিও রয়েছে। সেখানে আয়কর রিটার্ন দাখিলে দুই হাজার টাকা দিতে বাধ্য করা হলে সেটা অনেককে কর দেয়া থেকে অনুৎসাহিত করে তুলতে পারে।

ন্যূনতম আয়করে পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে বাজেট উত্তর সংবাদ সম্মেলনে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মোঃ রহমাতুল মুনিব বলেন, ‘কাদের টিআইএন থাকতে হয়, টিআইএন বাধ্যতামূলক কাদের, সেই লিস্টটা যদি সামনে নেন, তাহলে সেখানে দেখবেন টিআইএন বাধ্যতামূলক আমদানিকারক, রফতানিকারক, ট্রেড লাইসেন্সধারীর জন্য, কমিশন এজেন্সির জন্য। টিআইএন বাধ্যতামূলক পিস্তলের লাইসেন্সের জন্য। সিটি কর্পোরেশন এলাকায় বাড়ি, গাড়ির জন্য।'

তিনি বলেন, 'সাধারণ গরিব মানুষের কোনো অসুবিধা হবে না, সাধারণ গরিব মানুষের তো টিআইএন বাধ্যতামূলক নয়।'

জাতীয় বাজেট
বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী, কর শনাক্তকরণ নম্বর বা টিআইএন নম্বর থাকলেই বছর শেষে আয়ের হিসাব দিতে হয়। কিন্তু বাস্তবে এক তৃতীয়াংশ মানুষ এরকম রিটার্ন দাখিল করেন। গত অর্থ বছরের বাজেটে ৩৮ ধরনের সেবা পেতে আয়কর রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র বাধ্যতামূলক করা হলে তাতে রিটার্ন দাখিলের পরিমাণ খুব বেশি বাড়েনি।

এর ব্যাখ্যা হিসেবে তিনি বলছেন, যার আয় নেই, তিনি তো আর পাঁচ লাখ টাকার বেশি ঋণ নেবেন না বা ক্রেডিট কার্ড নেবেন না, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ানো বা গাড়ি কিনবেন না। এতদিন তারা হয়তো কোনো আয় নেই দেখিয়ে রিটার্ন জমা করতেন। কিন্তু সরকার যে ৩৮ বা ৪৪ ধরনের সেবা নিতে রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা দিয়েছে, সেই সুবিধা তারা নিতেন।

‘হয়তো তারা রিটার্ন জমা দিতেন না বা রিটার্ন জমা দিলেও আয় নেই বলে দেখাতেন। কিন্তু এখন এসব সেবা নিতে হলে তাদের ন্যূনতম এই করটা দিতে হবে। আর সারা বছরের হিসাব করলে এসব কর্মকাণ্ড থেকে তাদের যে আয় হয়, তার তুলনায় দুই হাজার টাকা বেশি নয়। যারা এসব সেবা নিতে চাইবেন না, তাদের তো আর এই ন্যূনতম কর দিতে হচ্ছে না,’ তিনি বলছেন।

বাজেটে ন্যূনতম কর আদায়ের প্রস্তাবনার বিষয়ে শনিবার ঢাকায় একটি সংবাদ সম্মেলনে ইন্সটিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেট অব বাংলাদেশ (আইসিএবি) একটি সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিল, তারা ওই প্রস্তাবকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন।

কারণ তিনি বলছেন, আইনে সকল টিআইএনধারীর রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা থাকলেও এখনো বেশিরভাগ মানুষ রিটার্ন দেন না। কিন্তু সরকারের ৪৪ ধরনের সেবা নিতে যারা রিটার্ন দাখিল করবেন, তারা এমনিতেই করের আওতার ভেতরে চলে এসেছেন।

প্রতিষ্ঠানটির ট্যাক্সেসন কমিটির চেয়ারম্যান মোঃ হুমায়ুন কবির বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘সরকার ন্যূনতম দুই হাজার টাকা কর দেয়ার যে প্রস্তাব দিয়েছে, এই কর কিন্তু ইতোমধ্যেই সবাইকে দিতে হচ্ছে। পাঁচ লাখ টাকার ওপরে সঞ্চয়পত্র বা ডিপোজিটের মুনাফা থেকে উৎস কর কেটে রাখা হচ্ছে। তাতে যে পরিমাণ কর উৎসে কেটে রাখা হচ্ছে, সারা বছরের হিসাব করলে সেটা কিন্তু দুই হাজার টাকার কাছাকাছি বা বেশি হতে পারে।‘

তিনি বলছেন, কিন্তু অনেকেই এভাবে কর দিলেও রিটার্ন জমা দেন না। আবার অনেকের এরকম আয় থাকলেও সেটা রিটার্নে দেখান না। কিন্তু এই উৎসে কেটে রাখা কর বছর শেষে আয়কর রিটার্নের সাথে সমন্বয়ের সুযোগ রয়েছে। সেটা হিসাব করলে অনেককে আর কোনো টাকা দিতে হবে না, বরং রিফান্ডও পেতে পারেন।

এ নিয়ে ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয় অনেকেই পক্ষে বিপক্ষে নানা ধরনের মন্তব্য করছেন।

যেমন শওগাত আলী সাগর নামে একজন লিখেছেন, ‘রিটার্নের প্রমাণপত্র পেতে করদাতাকে ন্যূনতম দুই হাজার টাকা আয়কর দিতে হবে বলে বাজেটে যে প্রস্তাব করা হয়েছে সেটি সম্পূর্ণ অন্যায় এবং অযৌক্তিক। এটা সত্য, উন্নত বিশ্বে ১৮ বছর হলেই নাগরিককে আয়কর রিটার্ন জমা দিতে হয়। কিন্তু তার জন্য কোনো ন্যূনতম ফি দিতে হয় না।‘

আবার ভিন্ন মত জানিয়ে লালন সিদ্দিকী নামে একজন তার ফেসবুক পাতায় লিখেছেন, ’বছরে ২ হাজার আয়কর দেওয়া নিয়ে অনেক কথা। আপনার আমার আয়কর দিয়ে শুধু সরকারি কর্মচারীদের বেতন দেওয়া হয়না, এরকম আরও অনেক জনকল্যাণমূলক কাজ করা হয়। এতো গোসসা না করে দেশ গঠনে, দেশের মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে অংশগ্রহণ করুন। বেশি না, মাত্রই তো ২ হাজার টাকা। যাদের কাছ থেকে ২ হাজার টাকা ন্যূনতম কর গ্রহণ করার প্রস্তাবনা এসেছে তারা আমরা কাজে অকাজে অনেক কাজে ২ হাজার টাকা ব্যয় করে থাকি।‘

রাজস্ব আয় কতটা বাড়াতে পারবে এই নীতি?
২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে, সেখানে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে পাঁচ লাখ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। সেখানে রাজস্ব আদায়ের ঘাটতি রয়েছে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা।




See More

Latest Photos