উম্মে কুলসুম পপি। উত্তরবঙ্গের লালমনিরহাটের মেয়ে। দেশের প্রথম নারী অ্যাগ্রো ইনফ্লুয়েন্সার। একজন কৃষি নারী উদ্যোক্তা হিসাবেও সফল। অনলাইনে কৃষিবিষয়ক ছোট ছোট ভিডিও, গোছানো কথোপকথন, সহজসরল বাচনভঙ্গিতে তথ্যের সরবরাহ করে দেশব্যাপী পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছেন। তার সঙ্গে কথা বলে লিখেছেন- ফরিদুল ইসলাম নির্জন
কৃষির প্রতি আলাদা মায়া সৃষ্টি হয়েছিল’ ‘শৈশব থেকেই





শৈশব ও কৈশোর
মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান পপি। গ্রামের মেয়ে হিসাবে পরিচয় দিতে খুব স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। শৈশব ও কৈশোর কেটেছে লালমনিরহাটে। যেখানে বিভিন্ন খেতের আলপথ ধরে হেঁটে, পচা পাটের ঘ্রাণে নিজেকে মাতিয়ে রেখে, প্রিয় নদীর পাড়ে চুপচাপ বসে থেকে পার করে দিয়েছেন জীবনের অনেকটা সময়। এ সম্পর্কে পপি বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই আমি বেশ সাহসী ছিলাম। গাছে ওঠা, সাইকেল চালানোসহ শৈশব ও কৈশোর থেকেই ছিল মা-মাটির সঙ্গে সখ্য। ধানখেতের আলপথ ধরে হাঁটতে প্রশান্তি কাজ করত ভীষণ। ছিল অন্য রকম আনন্দ। কৃষি জমিতে ধান চাষের সময় কত গিয়েছি। দেখেছি কীভাবে কৃষকরা চারা রোপণ করেন। ধান কেটে যখন বাড়িতে নিয়ে আসেন, সেই ঘ্রাণ আমার ভীষণ ভালো লাগত। মনের আনন্দে সেসব উপভোগ করতাম। পাট চাষ, বিভিন্ন ফল গাছ দেখতাম। বলতে পারেন শৈশব থেকেই কৃষির প্রতি আলাদা মায়া সৃষ্টি হয়েছিল।’
পপির বাবা একজন ব্যবসায়ী। দুই ভাই ও দুই বোনের সংসার। মা গৃহিণী। বাবা ব্যবসায়ী হলেও জমিতে ধান বা অন্যান্য ফসল আবাদ করতেন। চাচারাও চাষবাস করতেন। বাড়ির ফসলি জমিতে কাজের জন্য অন্যান্য মানুষ থাকলেও শৈশব থেকে পপি নিজেও যুক্ত থাকতেন এসব কাজে। পপি আরও বলেন, ‘বাবা ধান কেটে বাড়িতে আনলে, আমি সহযোগিতা করতাম। নিজে থেকে শেখার জন্য তা আনন্দ নিয়েই করতাম। কেন জানি এসব আমাকে খুব কাছে টানত।’
পড়াশোনা
মাধ্যমিক পর্যন্ত লালমনিরহাটে পড়াশোনা করেছেন পপি। এরপর রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূগোল ও পরিবেশ বিষয়ে স্নাতক পাশ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙ্গিনায় পা রেখেই নিজে কিছু করতে মরিয়া হয়ে ওঠেন পপি। ক্যাম্পাসে আসার পর বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ইচ্ছাটা প্রবল হতে থাকে। এ বিষয়ে পপি বলেন, “ক্যাম্পাসে প্রথম সেমিস্টারে ‘ক্রিয়েটিভ সোসাইটি’ নামে একটি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হতে গেলাম। সেখানে বিভিন্ন ফটোশপের কাজ, ছোট ছোট ভিডিও সম্পাদনার কাজ শিখি। আমাদের সঙ্গে আরও অনেকেই ছিলেন।’
বিয়ে এবং পারিবারিক সাপোর্ট
ক্যাম্পাসে কাজ করতে করতে একটা আইডিয়া নিয়ে বেশ সিরিয়াস হয়ে ওঠেন পপি ও সাগর। এরপর সহকর্মী থেকে সাগর হয়ে ওঠেন জীবনসঙ্গী। পপি বলেন, ‘আমি পড়াশোনা অবস্থায় যে বিজনেস করেছি, সে ব্যাপারে খুব সিরিয়াস ছিলাম। যেভাবে হোক কাজের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলাম। পড়াশোনা শেষ হবে, আমরা থেমে যাব-এমন ইচ্ছা ছিল না। বাংলাদেশে রিজনাল কনটেস্টে সিলেক্টেড হই। এরপর গন্তব্য ভারতের মুম্বাই। আমি বাড়িতে জানাই, তারা পুরোপুরিভাবে নিষেধ করেন। আমাকে যেতে দেবেই না। স্যার-ম্যাডাম বলেন, সাগর আর তোমার একসঙ্গে কাজ করতে হলে বিয়ে করতে হবে। আমিও ভাবি বিয়ে করা দরকার। পরে সাগর মুম্বাই থেকে ঘুরে আসে। কিছুটা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিই। তারপর পারিবারিকভাবে বিয়ের কাজটি সারি। ব্যবসায়িক কাজে আমরা দুজন একসঙ্গে থাকি। কাজের সুবাদে বিভিন্ন জায়গায় যাই একসঙ্গে। বিশেষ করে আমাদের বাগানগুলো নিজের সন্তানের মতো। আমরা দুজন গিয়ে খোঁজ নিই, ঠিক মতো পরিচর্চা হচ্ছে কিনা তা যাচাই করি। বলতে পারেন প্রচুর ভ্রমণ করি দুজন। খুব উপভোগ করি এ সময়গুলো।’
যেভাবে উদ্যোক্তা ও অ্যাগ্রো ইনফ্লুয়েন্সার
২০১৬ সালে বিডি অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে উদ্যোক্তা হিসাবে যাত্রা শুরু করেন পপি। এর মাধ্যমে পপি ও তার স্বামী পুরোপুরিভাবে কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। সেখানে একটি টিমের মাধ্যমে সেবা দিতে থাকেন। ২০২০ সালে কোভিড মহামারির চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ে যান। একদিকে সেই প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের বেতন, আরেক দিকে করোনা ঝুঁকি। পপি বলেন, ‘করোনা মহামরিতে ব্যবসার অবস্থা খুব খারাপ হলে নিজেরা মিলে ভিন্ন কিছু করার পরিকল্পনা করি। যেহেতু বাড়ি রংপুরে তাই ভাবলাম হাঁড়িভাঙ্গা আমের ব্যবসা করা যেতে পারে। তখন আমি আর আমার স্বামী এ ব্যাপারে খুব সিরিয়াস হই। পরে হাঁড়িভাঙ্গা আম বাগানে যাই। সেখানে কৃষকের সঙ্গে সরাসরি কথা বলি। বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ করি। হাঁড়িভাঙ্গা আম বিক্রি করা নিয়ে যেসব জটিলতা আছে আমরা সেগুলোর নোট করতে থাকি। এগুলো সমাধানের জন্য কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে পথ বের করি। আম কেনার ব্যাপারে তাদের সঙ্গে চুক্তি করি। আবার অনলাইনে কুরিয়ারের সঙ্গে কথা বলি, হোম ডেলিভারি ঠিকঠাক মতো পৌঁছানোর ব্যাপারে। ২০২০ সালে প্রিমিয়াম ফ্রুটস প্রতিষ্ঠা করি। এরপর অনলাইনে ব্যাপক প্রচারণা করতে থাকি। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের তাজা ও উচ্চমানের আম সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে আয় করাই মূল উদ্দেশ্য। ব্যাপক সাড়া পেতে থাকি এর মাধ্যমে। পরবর্তী সময়ে কৃষি কাজ করতে গিয়ে কৃষি শিক্ষার বই পড়তে থাকি। অনেক তথ্য সংগ্রহ করি। পান খেতে গিয়েছি, পানের উপকারিতা কী জানতে। তারপর কীভাবে পান চাষ হয়, তা জেনেছি। খোকসা, থানকুনি পাতা, ঘাস, লতাসহ অসংখ্য বিষয়ের পুষ্টিগুণ জেনেছি। তখন ভাবলাম এসব বিষয়ে অনেকেই জানেন না। তাদের মাঝে ভিডিও ছড়িয়ে দিতে থাকি। ২০২২ সালে কনটেন্টের মূল উপজীব্য হলো কৃষক ও তাদের চাষাবাদ নিয়ে। গহিন অরণ্যের কৃষকদের কথা তুলে ধরতে থাকি। তাদের চাষের ফসল-ফলাদি, মা-মাটিকে উপজীব্য করে এগিয়ে যেতে থাকি। খুব সহজেই মানুষের কাছে পরিচিত হতে থাকি। বর্তমানে রেগুলার ত্রিশজন এবং সিজনাল একশজন আমাদের সঙ্গে যুক্ত আছেন।
ব্যবসায়িক ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা
পপি বলেন, ‘দাম বৃদ্ধির ব্যাপারে অনেকের অভিযোগ থাকতে পারে। কিন্তু সেটা নিয়ে একটা ভাবনার খোরাক আছে। মাঠ পর্যায় থেকে পণ্যটি ভোক্তাদের কাছে পৌঁছানোর আগে বেশ কয়েকটি স্টেজ পার করতে হয়। রাস্তায় চাঁদাবাজি, সমিতিকে টাকা প্রদানসহ বিভিন্ন ধরনের অতিরিক্ত অর্থ দিতে হয়। স্বাভাবিকভাবে সেগুলো পণ্যর সঙ্গে যুক্ত করতে হয়। এতে করে পণ্যর দাম বেড়ে যাচ্ছে। ভোক্তা অধিকার শুধু দোকানে দোকানে গিয়ে হয়তো খোঁজ করছেন। কিন্তু মাঠপর্যায় থেকে ভোক্তাদের কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত বিভিন্নভাবে অর্থ দিতে হয় অহেতুক। এতে করে পণ্যের দাম বেড়ে যায়। ভোক্তারা প্রতারিত হন এ কারণে। এ ব্যাপারে নজরদারি বাড়ানো দরকার। বিয়ের আগে আমাদের সমাজে একজন নারী হিসাবে ব্যবসা করতে চাওয়া অনেকেই মানতে চান না। তখন সামাজিক বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা হতো। বিয়ের পার স্বামী-স্ত্রী মিলে একসঙ্গে ব্যবসা করি। ফলে সামাজিক সেসব প্রতিবন্ধকতা দূর হয়েছে।’
কোনো নারী যদি এ পেশায় আসতে চান
যে কোনো পেশাই একজন নারীর জন্য একটু বেশি সংগ্রামের। পপি বলেন, ‘আমি ও আমার হাজব্যান্ড একই জায়গাতে কাজ করি। যার ফলে খুব সহজ হয়ে গেছে। তবে যদি কোনো নারী এ পেশায় যুক্ত হতে চান, আমি বলব লেগে থাকতে হবে। যে কোনো কাজে উত্থান-পতন আছে। ধৈর্য ধরে থাকতে হবে। আমি মনে করি সফল বলতে জীবনে কিছু নেই। প্রতিটি মুহূর্তে সংগ্রাম করে এগিয়ে চলতে হবে। সবার সবকিছু শেষ হলেও কৃষি কখনো শেষ হবে না। কারণ আমাদের খাবার দাবার সবকিছু কৃষি থেকে। তাই এটাকে সেভাবে ভেবে এগিয়ে যেতে হবে।’