সমান অধিকার প্রসঙ্গ উত্তরাধিকার আইনে

Total Views : 19
Zoom In Zoom Out Read Later Print

বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশসংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এ সুপারিশমালার মধ্যে রয়েছে : ক. জাতীয় সংসদের আসনসংখ্যা ৬০০ নির্ধারণ ও তার মধ্যে ৩০০ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত রাখা। খ. বেঁচে থাকার অধিকার থেকে কাউকে বঞ্চিত না করা। অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ডের বিধান বিলোপ করা। গ. পারিবারিক আইনে সব বৈষম্য বিলুপ্ত করা তথা উত্তরাধিকারে নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। ঘ. জাতি ধর্ম নির্বিশেষে অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রবর্তন। ঙ. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বয়সের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ সমন্বিত যৌনশিক্ষা নিশ্চিত করা।

চ. অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান অপারেশন নিয়ন্ত্রণে আদালতের নির্দেশনা কার্যকর করা।

ছ. সব প্রতিষ্ঠানে ছয় মাস তথা ২৪ সপ্তাহ সবেতন মাতৃত্বকালীন ছুটি নিশ্চিত করা।

জ. শ্রম আইনে গৃহকর্মী ও যৌনকর্মীদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দান ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

সুপারিশমালার কয়েকটি বিষয়ে আমাদের বক্তব্য তুলে ধরছি :

১. এ সুপারিশমালার গভীরে গিয়ে চিন্তা করলে আমরা প্রচণ্ডভাবে উদ্বিগ্ন এবং আতঙ্কিত না হয়ে পারি না। কারণ প্রদত্ত সুপারিশমালার মধ্যে বেশ কয়েকটি সরাসরি আল-কুরআনের নির্দেশের সাথে সংঘর্ষিক। বাকিগুলো হয় মুসলিম জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে তথা একটি ঐতিহ্যবাহী মুসলিমপ্রধান দেশের লোকদের অবৈধ যৌনাচারের দিকে আহ্বানের নামান্তর অথবা এদেশের আপামর জনসাধারণকে ইসলামী সভ্যতা সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রের শামিল।

পারিবারিক আইন স্থগিতকরণ এবং উত্তরাধিকার আইনে নারী-পুরুষের মধ্যকার বৈষম্য বিলুপ্ত করার সুপারিশটি সরাসরি আল-কুরআনের সুস্পষ্ট বিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। কারণ আল-কুরআনের ঘোষণা হচ্ছে, ‘আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের সন্তানদের ব্যাপারে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, এক পুত্রের অংশ দুই কন্যার অংশের সমপরিমাণ। কিন্তু কেবল কন্যা দুয়ের অধিক থাকলে তাদের জন্য পরিত্যক্ত সম্পত্তির দুই-তৃতীয়াংশ, আর মাত্র একটি কন্যা থাকলে তার জন্য অর্ধাংশ।’ (সূরা আন নিসা, আয়াত-১১)

এ আয়াতটির সমাপ্তি টানা হয়েছে এ মন্তব্য করে, ‘ইহা আল্লাহর বিধান, আর আল্লাহ হচ্ছেন সর্বজ্ঞ, চূড়ান্ত প্রজ্ঞাময়।’

তাছাড়া পবিত্র আল-কুরআনের এই সূরার বিভিন্ন স্থানে উত্তরাধিকারসংক্রান্ত বিধানগুলোর উল্লেখের পাশাপাশি বলা হয়েছে, ‘এসব হচ্ছে আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সীমারেখা, আর যে কেউ আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য প্রদর্শন করবে তাকে তিনি প্রবেশ করাবেন এমন সব জান্নাতে যার পাদদেশ দিয়ে ঝর্ণাধারাসমূহ প্রবাহিত, তাতে তারা অনন্তকাল ধরে অবস্থান করবে, আর ইহা হচ্ছে মহাসাফল্য।’ (আয়াত-১৩)

‘আর যে কেউ আল্লাহ ও তার রাসূলের আদেশ অমান্য করবে এবং তার বেঁধে দেয়া সীমারেখা লঙ্ঘন করবে, তিনি তাকে প্রবেশ করাবেন জাহান্নামে, যথা সে অবস্থান করবে অনন্তকাল ধরে, আর তার জন্য থাকবে লাঞ্ছনাকর শাস্তি।’ (আয়াত-১৪)

এসব আয়াতসমূহ থেকে এ কথা স্পষ্ট, যারা আল্লাহ প্রদত্ত উত্তরাধিকার আইনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে তারা কত জঘন্য অপরাধ করেছে! তাদের জন্য অপেক্ষা করছে কতই না নিকৃষ্ট পরিণতি!

কমিশনের প্রধান শিরীন পারভিন হক মনে হয় কোনো মুসলিম পরিবারের সন্তান, অথচ তার নেতৃত্বে গঠিত কমিশন কর্তৃক আল-কুরআনের উত্তরাধিকার আইন বিলুপ্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে, যে বিষয়ে এমন কোনো দাবি বা আবদার বিগত চৌদ্দ শ’ বছরের ইতিহাসে কোনো ইসলামবিদ্বেষী প্রাচ্যবিদও করতে সাহস পায়নি।

২. সুপারিশমালার অন্যতম হচ্ছে : ‘সবার জন্য বেঁচে থাকার অধিকার নিশ্চিত করা এবং এর অংশ হিসেবে মৃত্যুদণ্ড রহিত করা।’

এ সুপারিশটি সরাসরি আল্লাহর বিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। কারণ আল্লাহর ঘোষণা হলো, ‘ওহে যারা ঈমানের ঘোষণা দিয়েছ, (শোনো!), তোমাদের প্রতি নিহত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে কিসাসের বিধান দেয়া হলো, স্বাধীন ব্যক্তির বদলে স্বাধীন ব্যক্তি এবং নারীর বদলে নারী।’ (সূরা আল বাকারা-১৭৮) পরবর্তী আয়াতে বলা হচ্ছে- ‘ওহে বোধসম্পন্ন ব্যক্তিগণ! কিসাসের মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে জীবন, যাতে করে তোমরা সতর্ক হতে পারো।’ (সূরা আল বাকারা-১৭৯)

কিসাস অর্থ হলো, ‘কারো হাতে কেউ অন্যায়ভাবে খুন হলে বিনিময়ে শাস্তিস্বরূপ তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া।’ লক্ষ করুন, এ আয়াতে বুদ্ধি-বিবেকসম্পন্ন লোকদেরকেই বিশেষভাবে সম্বোধন করা হয়েছে। এখানে ইঙ্গিত রয়েছে যে, হত্যার বিনিময়ে হত্যার বিধান কার্যকর করার ঘোষণা কী কল্যাণ রয়েছে তা তাদের কাছেই স্পষ্ট, যাদের কিছু বিবেক-বুদ্ধি রয়েছে। এর অর্থ দাঁড়ায় এই যে, যারা জীবনের অধিকার নিশ্চিত করার নামে কিসাসের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে তারা আসলে বিবেক-বুদ্ধিহীন, তথা হিতাহিত জ্ঞানশূন্য ব্যক্তি।

তাদের কাছেই প্রশ্ন করি, একজন লোক কোনো এক মহিলাকে ধর্ষণ করার পর তাকে হত্যা করল, সে ক্ষেত্রেও কি আপনারা সঙ্গত মনে করবেন তার থেকে মৃত্যুদণ্ড রহিত করা? অথবা কেউ যদি আপনার পিতাকে হত্যা করল তাতেও কি আপনি তার মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবেন? তাহলে এ সুপারিশের পেছনে আপনাদের উদ্দেশ্য কি আল্লাহর বিধানকে অসঙ্গত বলে চ্যালেঞ্জ করা?

৩. কমিশনের আরেকটি সুপারিশ হলো, ‘জাতি ধর্ম নির্বিশেষে অভিন্ন পারিবারিক (তথা উত্তরাধিকার আইন) প্রবর্তন করা- এ সুপারিশ অত্যন্ত হাস্যকর। কারণ, পারিবারিক আইন হচ্ছে মূলত ইসলামী বিধানের অংশবিশেষ যা একদিকে মুসলমানদের জন্য অলঙ্ঘনীয় বিধান, অন্যদিকে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের জন্য প্রযোজ্য নয়। প্রত্যেক জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব পারিবারিক বিধান রয়েছে। যার প্রত্যেকটি অন্যটির চাইতে ভিন্ন। তাই জাতি ধর্ম নির্বিশেষে অভিন্ন পারিবারিক বিধান প্রবর্তনের আবদার অত্যন্ত হাস্যকর।

৪. এ কমিশনের আরেকটি অদ্ভুত সুপারিশ হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাদের বয়সের সাথে সঙ্গতি রেখে সমন্বিত যৌনশিক্ষা প্রদানের সুপারিশ। এ সুপারিশের পেছনে যদি কোনো উদ্দেশ্য থেকে থাকে, তা হচ্ছে কিশোর-কিশোরী শিক্ষার্থীদের অপরিণত বয়সে অবৈধ যৌনচর্চার প্রতি সুড়সুড়ি দেয়া। এর বেশি বলা লজ্জাজনক বোধ করি। অন্তত এ কারণেই যে, এ সুপারিশটি বাস্তবায়নযোগ্য নয় এবং তা ভিন্ন দেশের প্রেসক্রিপশনে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের অংশ হিসেবে স্বৈরাচারী হাসিনা সরকার এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় প্রয়োগ করেছিল এবং পুরো জাতি এর অশুভ পরিণতি প্রত্যক্ষ করেছে এবং অভিভাবকসহ আপামর জনসাধারণ এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল। ফ্যাসিস্ট শাসনের পতনের পর এরা কি সেই ফ্যাসিজমের সাংস্কৃতিক ধারা পুনরায় প্রবর্তনের স্বপ্ন দেখছেন? তা তো কখনোই হতে পারে না।

৫. আরেকটি সুপারিশ হলো- শ্রম আইনে যৌনকর্মীদের স্বীকৃতি দান। এটিও অত্যন্ত হাস্যকর এ জন্য যে, এরা পতিতাবৃত্তিকে শ্রমজীবী পেশা হিসেবে স্বীকৃতিদানের সুপারিশ করছেন, যা নাকি নিকৃষ্ট ধরনের ব্যভিচার, অথচ কোনো ধর্মই ব্যভিচারকে বৈধ বলে স্বীকার করে না।

এদের শ্রমজীবীর মর্যাদা দান করার পেছনে এদের উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে, এর মাধ্যমে এসব যৌনকর্মীদের এ ধারণা দেয়া যে, তাদের এ পেশাটি একটি বৈধ কর্ম, তথা একটি সম্মানজনক পেশা। এ ধরনের সুপারিশ আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের শামিল। কারণ আল্লাহর ঘোষণা হচ্ছে, ‘আর তোমরা ব্যভিচারের ধারে কাছেও ঘেঁষো না। কারণ তা হচ্ছে অশ্লীলতা এবং গর্হিত পন্থা।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত-৩২)

যে কাজকে আল্লাহ অশ্লীলতা বলেছেন, সে কাজ আপনারা বলতে চাচ্ছেন একটি সম্মানজনক পেশা, আর যে কাজটিকে আল্লাহ গর্হিত পন্থা বলেছেন, সেটিকে আপনারা বলতে চান বৈধ পন্থা। কী ধৃষ্টতা!

আমরা দেখতে পাচ্ছি, এই সুপারিশমালার মাধ্যমে আপনাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে এদেশে অপসংস্কৃতি ও অশ্লীলতার বিস্তার। অথচ আল্লাহ বলছেন, ‘বস্তুত যারা চায় মুমিনদের মধ্যে (মুসলিমপ্রধান সমাজে) অশ্লীলতার বিস্তার ঘটাতে, তাদের জন্য রয়েছে ইহকালে ও পরকালে পীড়াদায়ক শাস্তি, আর আল্লাহ জানেন, তোমরা তো জানো না।’ (সূরা আন-নূর, আয়াত-১৯)

কমিশনের অবস্থান দেখে আমাদের এ সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, তারা আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি বিশ্বাস রাখেন কিনা। আল্লাহর ঘোষণাটি তাদের জন্য উল্লেখ করতে চাই, আল্লাহ বলছেন, ‘কোনো বিশ্বাসী মুমিন পুরুষ কিংবা নারীর এ অধিকার নেই যে, কোনো বিষয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোনো সিদ্ধান্ত দিলে সে বিষয়ে তাদের নিজেদের কোনো ইচ্ছার স্বাধীনতা আছে বলে মনে করা, আর যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্যতা প্রদর্শন করবে সে সন্দেহাতীতভাবে সুস্পষ্ট পথভ্রষ্টতার পথে বহুদূরে অবস্থান করছে।’ (সূরা আল আহজাব, আয়াত-৩৬)

লেখক : সাবেক ভাইস-চ্যান্সেলর, আইআইইউসি, ভাইস চেয়ারম্যান, শরিয়াহ সুপারভাইজরি কাউন্সিল, ইসলামী ব্যাংক

See More

Latest Photos